কুমিল্লার দুঃখ নামে খ্যাত গোমতী নদীর বাঁধ ভাঙ্গার পর পানিতে তলিয়ে গেছে বুড়িচং- ব্রাহ্মণপাড়া উপজেলার শত শত গ্রাম। তীব্র পানির স্রোতে কেড়ে নেয় মানুষের বসতবাড়ি ও রাস্তাঘাট। গত কয়েকদিন ধরে কমছে বন্যার পানি। বন্যার পানি কমার সাথে সাথে ভেসে উঠছে রাস্তাঘাট ও বসত বাড়ির ধ্বংসস্তূপ। ভয়াবহ বন্যার পানি নেমে গেলেও বুড়িচং ও ব্রাহ্মণপাড়ায় রেখে গেছে রাস্তা-ঘাট ও বসতবাড়ি এবং ফসলের ব্যাপক ক্ষতচিহ্ন। বন্যা কবলিত এলাকা বুড়িচং ও ব্রাহ্মণপাড়া উপজেলার বিভিন্ন গ্রাম ঘুরে দেখা যায়, অনেক বসত বাড়িতে এখনো পানি রয়েছে। ধীরগতিতে পানি কমায় চরম দুর্ভোগ পোহাচ্ছে বুড়িচং ও ব্রাহ্মণপাড়ার বন্যার্তরা। পানি কমায় মানুষের মাঝে স্বস্থি ফিরলেও এসব এলাকার সড়ক ও বাড়িঘর এবং ফসলের ভেসে উঠছে বন্যার ক্ষত। অন্যদিকে ত্রানসামগ্রী পেলেও চরম ভোগান্তিতে দিন কাটাচ্ছে দুর্গত এসব বাসিন্দারা। বুড়িচং উপজেলার ভরাসার, ইছাপুরা, বুড়বুড়িয়া, কালিকাপুর, ভবানীপুর বাকশিমূল, যদুপুর, জগতপুর, সাদকপুর, শিবরামপুর সহ অধিকাংশ সড়ক ভেঙে খাদে পরিণত হয়েছে। এ উপজেলার বেশিরভাগ গ্রামীণ সড়ক ঢলের পানিতে বিলীন হয়ে গেছে। বন্যাদুর্গত এলাকার অনেক আঞ্চলিক ও গ্রামীণ সড়ক বিধ্বস্ত হয়েছে। ভেঙে গেছে কাঁচা ঘর। পাকা ঘরের আসবাবপত্রসহ বসবাসের নানা সরঞ্জামও পানিতে নষ্ট হয়েছে। ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে ব্রীজ-কালভার্ট। এছাড়া কৃষি ও মৎস্য, প্রাণী সম্পদেরও ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। ভেসে গেছে ফসলি জমি, মাছ, মুরগি ও গরু-ছাগলের খামার। এতে অনেক কৃষক ও খামারি পুঁজি হারিয়ে নিঃস্ব হয়েছেন। এদিকে বন্যার পানি যতই কমে আসছে দুর্গত এলাকায় পানিবাহিত রোগবালাই বাড়ছে। ডায়রিয়া, ইনফেকশন, চর্মরোগসহ জেলার বন্যাকবলিত এলাকার অন্তত আট হাজারের বেশি মানুষ আক্রান্ত হয়েছেন। বুড়িচং উপজেলার স্বেচ্ছাসেবি মোঃ সাইফুল ইসলাম রমজান বলেন, এই বছরের বন্যায় মানুষের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। তার নিজের মৎস প্রকল্পের প্রায় ২০ লক্ষ টাকার ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। স্থানীয় ব্যবসায়ী আলী আক্কাস জানান, এই বছরের বন্যায় তার মৎস প্রকল্প ও মুরগির খামারের প্রায় ২৫ লক্ষ টাকার ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। সব কিছু হারিয়ে সে এখন নিঃস্ব হয়ে গেছে। স্মরণকালের ভয়াবহ বন্যার মুখোমুখি হয়েছে ব্রাহ্মণপাড়া উপজেলা। উজানের টানা ভারি বৃষ্টি ও পাহাড়ি ঢলে গোমতী নদী এবং সালদা নদীর প্রতিরক্ষা বাঁধ ভেঙে উপজেলার মোট আয়তনের ৯৫ শতাংশ এলাকা প্লাবিত হয়েছে। এতে এ উপজেলায় পানিবন্দি হয়ে পড়েছে ৭০ হাজার পরিবার। বন্যায় ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৮৫০ কোটি টাকা। প্রাণিসম্পদে ৬ কোটি টাকার ক্ষতি হয়েছে। তবে এ ক্ষতির পরিমাণ দিন দিনই বাড়ছে বলেও জানিয়েছেন উপজেলা প্রাণিসম্পদ বিভাগ। উপজেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তার কার্যালয় সূত্র জানায়, দুটি নদীর বাঁধ ভেঙে প্লাবিত হয়ে অতিরিক্ত পানির কারণে এ উপজেলার ৮টি ইউনিয়নের মধ্যে ৬টি ইউনিয়নে প্রাণিসম্পদের বেশি ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। এ ছাড়াও অন্যান্য ইউনিয়নের খামারি ও গৃহস্থরা সামান্য ক্ষতির মুখে পড়েছেন। বেশি ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছেন মুরগির খামারিরা। এ উপজেলায় পশু ও পাখির খামার মিলিয়ে মোট ২৮৭টি খামার ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে। পশু ও পাখির ক্ষতিসহ খামারের অবকাঠামোগত ক্ষতি এবং পশু-পাখির খাবার বিনষ্ট হয়ে এ উপজেলায় বন্যায় মোট ক্ষতি হয়েছে ৬ কোটি টাকা। তবে প্রতিদিনই ক্ষতির পরিমাণ বাড়ছে। উপজেলার সদর ইউনিয়নের মহালক্ষীপাড়া এলাকার বাসিন্দা খামারি আবদুল কাদির কালবেলাকে বলেন, আমার দুই বিঘা জমির ঘাস বন্যার পানিতে ডুবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। আমার একটি গরুর ফার্ম ও ৩টি মুরগির ফার্ম বন্যার পানির কারণে ক্ষতিগ্রস্থহয়েছে। কিছু মুরগি মারা যাওয়ার পর আমি কম দামে লোকসান গুণে অনেক মুরগি বিক্রি করে দিই। সব মিলিয়ে আমার ৭০ হাজার টাকার ক্ষতি হয়েছে। আরেক পশু খামারি সাদেক হোসেন বলেন, হঠাৎ আসা বন্যায় আমার ২৫টি গরুর একটি খামার অবকাঠামোগত ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে। এখনো খামার থেকে পুরোপুরিভাবে পানি নামেনি। গরুগুলো সড়কের ওপর রেখে রাত জেগে পাহারা দিচ্ছি। বন্যার পানি নেমে গেলে খামারটি নতুন করে উপযোগী করতে হবে। এতে আমাকে নতুন করে পুঁজি বিনিয়োগ করতে হবে। বন্যার কারণে আমি ক্ষতির মুখে পড়ে গেলাম। ব্রয়লার মুরগির খামারি নজরুল ইসলাম বলেন, ভয়াবহ বন্যায় আমার ১ হাজার ২০০ মুরগি মরে গেছে। অবশিষ্ট মুরগিগুলোও অসুস্থ হয়ে পড়েছে। এ ছাড়াও আমার দুটি খামার অবকাঠামোগত ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এতে আমার ২ লাখ টাকার বেশি ক্ষতি হয়েছে। এ ক্ষতি আমার পোষাবার নয়। আমি ক্ষুদ্র খামারি, আমি পথে বসে গেছি। ব্রাহ্মণপাড়া উপজেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা ডা. ইজমাল হাসান বলেন, আকস্মিক বন্যায় ব্রাহ্মণপাড়ায় প্রাণিসম্পদের ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। এতে উপজেলার ৬টি ইউনিয়নের খামারি ও গৃহস্থরা বেশি ক্ষতির মুখে পড়েছেন। এতে এ উপজেলায় প্রাণিসম্পদের প্রায় ৬ কোটি টাকার ক্ষতি হয়েছে। প্রতিদিনই নতুন খামারি গিয়ে তাদের ক্ষতির পরিমাণ অফিসে জানাচ্ছেন এবং এ হিসাবটি প্রতিদিনই বৃদ্ধি পাচ্ছে। বন্যার কারণে মাঠে চাষ করা ঘাস তলিয়ে যাওয়ায় পশু খাদ্যের সংকট দেখা দিয়েছে। ডা. ইজমাল হাসান বলেন, বন্যাপরবর্তী সময়ে মানুষের মতো পশু পাখিদেরও নানা রোগ দেখা দেবে। এ সংকট কাটিয়ে উঠতে আমরা ইতোমধ্যে পদক্ষেপ গ্রহণ করেছি। এ থেকে উত্তরণে মাঠপর্যায়ে আমাদের লোক কাজ করছে। আমরা ভ্যাকসিন আনতে ও ওষুধের জন্য ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ বরাবর প্রতিবেদন পাঠিয়েছি। আশা করছি, শিগগিরই আমরা তা পেয়ে যাব। ক্ষতিগ্রস্তদের তালিকা প্রতিদিনই আপডেট হচ্ছে। আমরা এ তালিকা তৈরি করে উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন অফিসে জমা করে দেবো। আশা করছি, ক্ষতিগ্রস্থ খামারিসহ সংশ্লিষ্ট ক্ষতিগ্রস্থরা উপকারভোগী হবেন। ব্রাহ্মণপাড়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) স ম আজহারুল ইসলাম বলেন, আকস্মিক বন্যায় উপজেলার ৮টি ইউনিয়নের ৭৫টি গ্রামের মধ্যে ৬৮টি গ্রাম প্লাবিত হয়ে ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে। এতে পানিবন্দি হয়ে পড়েছে ৭০ হাজার বানভাসী পরিবার। ডুবে গেছে ফসলের মাঠ, মাছের ঘের, মুরগির খামার। ডুবে গিয়ে নষ্ট হয়েছে অধিকাংশ রাস্তাঘাট, কালভার্ট-ব্রিজ। নষ্ট হয়েছে আসবাবপত্র ও গৃহস্থালি সামগৃী। ক্ষতির মুখে পড়েছে গৃহপালিত গবাদিপশু। যার ফলে বন্যায় এ উপজেলায় প্রায় ৮৫০ কোটি টাকার ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। বুড়িচং উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা সাহিদা আক্তার বলেন, গোমতী নদীর বাঁধ ভাঙ্গার ফলে বুড়িচং উপজেলায় ৫শত ৫৭ কোটি টাকার ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। সবচেয়ে বেশি ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে সড়কে। উপজেলার বিভিন্ন সড়কের ৮৯ কোটি টাকার ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। কৃষি শস্য সম্পূর্ণ বিনষ্ট হয়েছে ৩হাজার ৪শত ৪৬ হেক্টর জমির এবং আংশিক বিনষ্ট হয়েছে ২হাজার ৫ শত ৩০ হেক্টর জমি ও বীজতলা ৩শত ১০ হেক্টর জমির, মৎস ক্ষেত্রে বিনষ্ট হয়েছে ৪শত ১০ হেক্টর এলাকার (যা ৮৮ কোটি ৯১ লক্ষ টাকা), হাস- মুরগী৩কোটি ২লক্ষ ৫০ হাজার ৬৫০টাকা, ভেড়া ২৫ হাজার টাকা, ছাগল ২ লক্ষ ৪৭ হাজার, গরু ১০ লক্ষ ৮০হাজার টাকাসহ ৫শত ৫৭ কোটি টাকার ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। এই ক্ষয়ক্ষতি পুঁষিয়ে নেওয়ার জন্য ইতিমধ্যে কৃষকদের জন্য প্রণোদনা আসছে এবং আরো আসবে। প্রাণী সম্পদ অফিসের মাধ্যমে খামারীদের তালিকা তৈরী করা হচ্ছে।