কুমিল্লায় দেশের ৫১ শতাংশই বাল্যবিয়ে সম্পূর্ণ হয়

লেখক: স্টাফ রিপোর্টার
প্রকাশ: ৮ মাস আগে

Spread the love

২০১৮ সালের ডিসেম্বর কুমিল্লাকে ‘বাল্যবিয়ে মুক্ত’ ঘোষণা করেছিলেন তৎকালীন জেলা প্রশাসক আবুল ফজল মীর। কিন্তু তার সেই ঘোষণার পর এ জেলায় বাল্যবিয়ে বন্ধ হওয়া তো দূরের কথা বরং দিন দিন এ প্রবণতা আরো বেড়েছে। জেলা মহিলা বিষয়ক কর্মকর্তার কার্যালয় থেকে প্রাপ্ত তথ্যে জানা গেছে, গত ৫ বছরে জেলা জুড়ে ৪২২টিরও বেশি বাল্যবিয়ে বন্ধ করা হয়েছে। আর বাল্যবিয়ে হয়েছে এ সংখ্যার কয়েকগুণ। যদিও বাল্যবিয়ে সম্পাদন সংক্রান্ত কোনো তথ্য এ কার্যালয়ে নেই। দিন দিন কুমিল্লাজুড়ে বাল্যবিয়ের প্রবণতা বেড়ে যাওয়ার বিষয়টিকে ‘আশঙ্কাজক’ বলে আখ্যা দিয়েছেন জেলার বিশিষ্টজনরা। তারা বলছেন, এখনই সময় বাল্যবিয়ে বন্ধে সমন্বিত উদ্যোগ ও এর প্রতিরোধে ব্যবস্থা গ্রহণ করার। মহিলা বিষয়ক অধিদপ্তর কুমিল্লা কার্যালয় সূত্রে জানা গেছে, কুমিল্লাকে বাল্যবিয়ে মুক্ত ঘোষণার পরের বছর ২০১৯ সালে জেলায় ১২৩টি বাল্যবিয়ে বন্ধ করা হয়েছে। ২০২০ সালে বাল্যবিয়ে বন্ধ করা হয় ৫৭টি, ২০২১ সালে ৫৮টি, ২০২২ সালে ৭২টি। আর গেলো বছর অর্থাৎ ২০২৩ সালে জেলায় বাল্যবিয়ে বন্ধ করা হয়েছে ১০২টি। এর মধ্যে জেলা আইনশৃঙ্খলা কমিটির তথ্য অনুযায়ী গেলো বছরের ডিসেম্বর মাসে কুমিল্লায় ১১টি বাল্যবিয়ে বন্ধ করা হয়। প্রতিটি উপজেলার মাসিক মিটিং থেকে প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী এসব সংখ্যা লিপিবদ্ধ করা হয়। এ তথ্য থেকেই বোঝা যায় জেলাজুড়ে বাল্যবিয়ের প্রবণতা কতোটা ব্যাপক হারে বেড়েছে। অপরদিকে দপ্তর থেকে প্রাপ্ত তথ্যের সূত্র উল্লেখ করে জেলা মহিলা বিষয়ক অধিদপ্তরের উপ পরিচালক জানিয়েছেন, দেশে যে পরিমাণ বাল্যবিয়ে সংঘটিত হয় এর ৫১ শতাংশই কুমিল্লায়। যদিও এর সঠিক সংখ্যাটা কুমিল্লায় কোথাও নেই। মূলত প্রবাসী অধ্যূষিত জেলা হওয়ায় কুমিল্লায় বাল্যবিয়ের প্রবণতা বেশি বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টারা। এ বিষয়ে জানতে চাইলে মহিলা বিষয়ক অধিদপ্তর কুমিল্লার উপ পরিচালক জেসমিন আরা বেগম বলেন, ২০১৮ সালের ডিসেম্বরে কুমিল্লাকে বাল্যবিয়ে মুক্ত করার ঘোষণা দেওয়া হলেও তা বাস্তবায়নে সমন্বিত প্রচেষ্টার অভাব আছে। শুধুমাত্র মহিলা বিষয়ক অধিদপ্তর, পুলিশ প্রশাসন এবং উপজেলা প্রশাসন এই বাল্যবিয়ে পুরোপুরি বন্ধ করতে পারছি না। এ জেলার অধিকাংশ মানুষই দেশের বাইরে থাকে। যার ফলে এ অঞ্চলের মেয়েদের প্রবাসী বিয়ে করার ‘ট্রেন্ড’ আছে। বিশেষ করে দরিদ্র পরিবারের মেয়েদের প্রবাসী ভালো পাত্র পেলে বিয়ে দিয়ে দিতে চান অভিভাবকরা। আমরা যেসব বিয়ে বন্ধ করি এগুলো শুধুমাত্রা প্রাপ্ত তথ্যের ভিত্তিতে। তার মানে এই না যে, গোপনে আরো বিয়ে হয় না। তাছাড়াও অনেক ধনী পরিবারেও বাল্য বিয়ে হয়। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে অতিরিক্ত গোপনীয়তার কারণে এসব তথ্য আমরা পাই না। তিনি বলেন, লক্ষ্য করা যাচ্ছে, কুমিল্লায় বাল্য বিয়ে বাড়ছে। সেদিন আমাদের তথ্য দপ্তর থেকে জানানো হলো- সারা দেশে যে পরিমাণ বাল্যবিয়ে হচ্ছে তার ৫১ শতাংশই হচ্ছে কুমিল্লায়। এমন কোনো মাস নেই, যে মাসে আমাদের এখানে ১০/১২টা বাল্যবিয়ে বন্ধ করা হয় না। এ থেকেই বোঝা যায় কুমিল্লা বাল্যবিয়ের প্রবণতা কতোটা বেড়েছে। এর কারণ বাল্যবিয়ে বন্ধে যে সমন্বিত প্রয়াসÑ সেটা নেওয়া যাচ্ছে না। আইনে আছে ইউএনও, ম্যাজিস্ট্রেট, অন্যান্য কর্মকর্তা ও থানার ওসি- সবাই সমন্বিতভাবে প্রচেষ্টা চালাবে। এছাড়া ইউনিয়ন পর্যায়ে কমিটি আছে, ইউপি চেয়ারম্যান যার সভাপতি। ইউনিয়ন কমিটিগুলো এক্টিভ না। অনেক সময় রাত ১০টায় বাল্যবিয়ের তথ্য নিয়ে ফোন আসে। কিন্তু সে সময় আমরা কোনো লজিস্টিক সাপোর্ট পাই না। প্রায় সময়ই দেখা যায় সংশ্লিষ্ট চেয়ারম্যান/মেম্বাররা সাড়া দেন না। ফলে অনেক সময় তথ্য জানা সত্বেও আমরা বিয়েটা বন্ধ করতে পারি না। এটা শুধুমাত্র আমাদের সীমাবন্ধতার কারণে। সবাই বাল্যবিয়ে বন্ধের কথা বললেও এটার জন্য যে কৌশলগত পন্থা অবলম্বন করা উচিৎ তা নেওয়া হয় না। আইনে এতগুলো কর্মকর্তার কথা বলা থাকলেও ধরে নেওয়া হয়, বাল্যবিয়ে বন্ধ করার মহিলা বিষয়ক কর্মকর্তার কাজ। ‘জেলায় কতগুলো বাল্যবিয়ে হলো এর কোনো তথ্য আপনাদের কাছে নেই, কেন’? এর জবাবে তিনি বলেন, এসব বিয়ের ইনফরমেশন আমাদের কাছে আসে না। তথ্য না পেলে আমি কিভাবে সংগ্রহ করবো। তবে তথ্যটা রাখতে পারলে ভালো হতো। তারপরও আমরা সচেতনতা বাড়ানোর লক্ষ্যে কাজ করে যাচ্ছি। কিন্তু সচেতন করার কাজটা অনেক জটিল। কাউকে জোড় করে সচেতন করা যায় না। আমাদের ১৯৪টি কিশোর-কিশোরী ক্লাব আছে, সেগুলোর মাধ্যমে আমরা জোড়ালো কার্যক্রম চালাই। এখানে কাজীর একটা বাধ্যবাধকতা থাকা উচিৎ। বাল্যবিয়ের জন্য যদি কাজীদের শাস্তির আওতায় আনা হতো, লাইসেন্স বাতিল করা হতো- এমন কয়েকটা দৃষ্টান্ত যদি আসতোÑ সেক্ষেত্রে সতর্কতা আরো বাড়তো। পাশাপাশি গ্রাম পর্যায়ে ওয়ার্ড মেম্বারদের কাছে কিন্তু এসব তথ্য থাকে। তার ওয়ার্ডে কোথায় বাল্যবিয়ে হচ্ছে তিনি কিন্তু জানেন। ওয়ার্ড মেম্বার যদি সচেতন হন বাল্যবিয়ে অনেকাংশে কমে আসবে বলে মনে করেন তিনি। জানতে চাইলে কুমিল্লার বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা ‘প্রত্যয়’এর নির্বাহী পরিচালক মাহমুদা আক্তার বলেন, কুমিল্লায় আগের তুলনায় বাল্যবিয়ে কিছুটা কমলেও যতোটা আশা করা হয়েছিলো, সেরকম কমেনি। এক্ষেত্রে শুধু অভিভাবকদেরকে দোষারুপ করেও লাভ নেই। অনেক ক্ষেত্রেই দেখা যায়, উঠতি বয়সি ছেলে-মেয়েরা প্রেম কিংবা অন্যান্য কারণে আবেগের বশবর্তী হয়ে বিয়ে করে ফেলছে। এর প্রভাবটা পড়ে সংসার জীবনে গিয়ে। শারীরিক ও মানসিক ইনমেচিউরিটির কারণে তারা সংসারে খাপ খেয়ে উঠতে পারে না। অনেক ক্ষেত্রেই এসব সংসার ভেঙ্গে যায়। কুমিল্লায় কিন্তু ইদানিং ডিভোর্সের সংখ্যা বেড়ে গেছে। বাল্য বিয়ে এর একটি কারণ। তিনি বলেন, আমরা আমাদের এনজিওর মাধ্যমে বাল্যবিয়ে প্রতিরোধে সচেতনা কার্যক্রম পরিচালনা করে থাকি। অভিভাবকদের মাঝে বাল্যবিয়ের অভিশাপের চিত্রটা তুলে ধরি। যেহেতু বাল্য বিয়ে বন্ধ করে দেওয়ার এখতিয়ার আমাদের নেই, তাই আমরা এরকম কোনো তথ্য পেলে সরকারি সংস্থা ও প্রশাসনকে অবহিত করি। ব্রাহ্মণপাড়া উপজেলা বাল্যবিয়ে প্রতিরোধ কমিটির সদস্য সৈয়দ আহাম্মদ লাভলু বলেন, কুমিল্লায় বাল্যবিয়ের প্রবণতা আশঙ্কাজনক হারে বেড়েছে। প্রত্যন্ত গ্রামাঞ্চলে বাল্যবিয়ের প্রবণতা তুলনামূলক বেশি। আমরা বিভিন্ন সূত্রে জানতে পেরে কিছু বিয়ে বন্ধ করলেও বেশিরভাই অজানা থেকে যায়। কিছু কিছু ক্ষেত্রে দেখা যায়, যেহেতু বিয়ের বয়স কম হলে কাবিননামা সম্পন্ন করতে সমস্যা হয় তাই অল্প বয়সী ছেলে-মেয়ের দুই পরিবারের সমঝোতায় আকদ সম্পন্ন করে রাখে। পরে একসময় কাবিননামা রেজিস্ট্রি করে ফেলে। সকলে সচেতন না হলে বাল্যবিয়ে বন্ধ করা যাবে না। এ বিষয়ে যোগাযোগ করা হলে কুমিল্লার জেলা প্রশাসক খন্দকার মু. মুশফিকুর রহমান বলেন, বাল্যবিয়ে বন্ধ করতে আমাদের অবস্থান স্পষ্ট। আমরা শক্ত অবস্থানে আছি। প্রতি সপ্তাহেই কোথাও না কোথাও বাল্যবিয়ে বন্ধ হচ্ছে। মানুষজনকে সামাজিকভাবে সচেতন করার চেষ্টা করছি। আমরা যেখানেই যাচ্ছি, জনগসমাগমে বাল্যবিয়ের কুফল তুলে ধরছি। বাল্যবিয়ে প্রতিরোধে প্রশাসনের দিক থেকে আন্তরিকতার কোনো অভাব নেই। ‘অনেক সময় জনপ্রতিনিধি কিংবা দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তারা অসহযোগিতা করেন বলে অভিযোগ ওঠেÑ তাদের সম্পৃক্ততা আরো কিভাবে বাড়ানো যায়?’ এমন প্রসঙ্গে জেলা প্রশাসক বলেন, জেলা উন্নয়ন সমন্বয় কমিটির সভা কিংবা আমরা যখন আলাদাভাবে বসি, তখন এ বিষয়ে কথা বলি । তাদের কাছ থেকে কোনো ধরনের অসহযোগিতা করা হয়Ñ এমন তথ্য আমার জানা নেই। বরং তারা সহযোগিতা করেন বলেই প্রতি সপ্তাহে একটা না একটা বাল্যবিয়ে বন্ধ করা যাচ্ছে। তথ্যটা তাদের কাছ থেকেই আসছে। এছাড়া স্থানীয়ভাবে বাল্যবিয়ে বন্ধ করতে গেলে চেয়ারম্যান-মেম্বারদের সহযোগিতাই প্রথমে নিতে হয়। তাদের সহযোগিতার কারণেই এতগুলোতে বাল্যবিয়ে বন্ধ করা সম্ভব হয়েছে।

  • কুমিল্লা