বুড়িচং-ব্রাহ্মণপাড়ায় গত ৩০ বছর যাবৎ একমাত্র শ্রমিকের হাট খাড়াতাইয়া বাজার

লেখক: স্টাফ রিপোর্টার
প্রকাশ: ১১ মাস আগে

Spread the love

কুমিল্লার বুড়িচং-ব্রাহ্মণপাড়া উপজেলার একমাত্র শ্রমিকের হাট বসে বুড়িচং উপজেলার ষোলনল ইউনিয়নের খাড়াতাইয়া নতুন বাজারে। এই বাজারটি ১৯৬৭-৬৮ সালে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। প্রায় ৫৫ বছর পূর্বে এই বাজারের গোড়াপত্তন হলেও বর্তমানে কামলা বাজার কিংবা শ্রমিকের বাজার হিসেবে বেশ পরিচিতি লাভ করেছে। দীর্ঘ ৩০ বছর ধরে এই বাজারে দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে দলে দলে শ্রমিক কাজ করার জন্য আসে। তারা দিনমজুর হিসেবে কাজ করে। বিশেষ করে উত্তর বঙ্গের লোকজনই বেশি আসে। রংপুর, গাইবান্ধা, ময়মনসিংহ, নেত্রকোনা, সিলেট, ঠাকুরগাঁও, জামালপুরসহ দেশের বিভিন্ন প্রান্তের লোকজন দিনমজুর হিসেবে কাজ করার জন্য এই বাজারে জমাট হয়। প্রত্যেক দিন ফজর নামাজের পর শ্রমিকরা জড়ো হতে থাকে এবং সকাল ৮টার মধ্যে তারা বিভিন্ন এলাকায় কাজ নিয়ে চলে যায়। এ সময়ে বুড়িচং উপজেলা ও ব্রাহ্মণপাড়া উপজেলার বিভিন্ন গ্রামের কৃষকরা তাদের চাহিদা মতো শ্রমিক নিয়ে যায়। সারা বছরই শ্রমিক পাওয়া যায়। খাড়াতাইয়া নতুন বাজারের আশ-পাশের বিভিন্ন লোকজন ঘর করে দিয়েছে দূর-দূরান্ত থেকে আসা শ্রমিকদের রাত্রি যাপন করার সুবিধার্থে। এই সব ঘরগুলো জনপ্রতি দৈনিক ২০ টাকায় ভাড়া প্রদান করা হয়। এই ঘরগুলোতে মাসের পর মাস নিরাপত্তার মধ্যে দিয়ে বসবাস করতে পারে। যার ফলে দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে ধান কাটা এবং ধানের চারা রোপন করার মৌসুমে দলে দলে শ্রমিকের আগমন ঘটে। তবে সারা বছরই কম বেশি শ্রমিকের আনাগোনা থাকে। সিলেট জেলার ছাতক উপজেলার তারেক আহমেদ এই বছরই প্রথম দিনমজুর হিসেবে কাজ করার জন্য এ বাজারে এসেছে। কৃষকদের সাথে মজুরী নিয়ে দরকষাকষি করছে। সে অন্যান্য শ্রমিকদের মুখে শুনে প্রায় মাসখানেক পূর্বে এখানে এসেছে। দৈনিক ২০ টাকায় ঘর ভাড়ায় থাকছে। যে দিন কাজ থাকে না সেই দিন পাশের হোটেলে খাওয়া দাওয়া করে। তবে এখানে তাদের তেমন কোন অসুবিধা হয় না। স্থানীয় লোকজন তাদেরকে সহযোগীতা করে। তবে থাকা খাওয়ার সুবিধা থাকলেও শৌচাগার নিয়ে অনেক অসুবিধা পোহাতে হয়। বিশেষ করে গোসল করতে সমস্যা হয়। মসজিদের পুকুরে গিয়ে গোসল করা এবং কাপড় ধুতে হয়। নেত্রকোনা জেলার দূর্গাপুর উপজেলার সাঘাই চন্দিঘর গ্রামের মোঃ মুনতাজ আলী। তিনি প্রায় ২০ বছর ধরেই এখানে এসে দিনমজুর হিসেবে কাজ করেন। এক মেয়ে দুই ছেলে নিয়ে তার সংসার। সংসারে খরচ বহন করতে বছরের বেশিরভাগ সময়ই দিনমজুর হিসেবে বাড়ির বাহিরে থাকতে হয়। তিনি দুঃখ করে বলেন-কোথাও গরীবের আরাম নেই, মূল্যায়ন নেই। জিনিসপত্রের দাম যেভাবে বাড়ছে কিন্ত আমাদের শ্রমের মূল্যে সেই ভাবে বাড়ে নাই। কেউ আমাদের দুঃখ বুঝে না। দিনমজুর হিসেবে কাজ করে কোন মতে জীবনটাকে বাঁচিয়ে রেখেছেন। তিনি বলেন-কিছু সংখ্যক দুষ্ট প্রকৃতির কৃষক আছে-যারা শ্রমিকের সাথে খারাপ আচরণ করে। তবে সবাই খারাপ না। বেশিরভাগই ভালো। তারা ভালো ব্যবহার করে বলেই আমরা এখানে আসি। স্থানীয়রা আমাদেরকে নিরাপত্তা প্রদান করে বলেই আমরা শান্তিতে বসবাস করে দিনমজুর হিসেবে এই এলাকায় কাজ কর্ম করতে পারি। তবে সরকারী ভাবে যদি গণ শৌচাগার করে দেওয়া হয় তাহলে আমাদের শ্রমিকদের অনেক উপকার হবে। হরিপুর গ্রামের কৃষক আবুল কাশেম বলেন-এক সময় স্থানীয় শ্রমিকরা কাজ করতো। কিন্ত এখন আর স্থানীয় লোকজন কাজ কর্ম করে না। বিশেষ করে এই এলাকার শ্রমিকরা বিদেশ পাড়ি দেওয়ার ফলে স্থানীয় শ্রমিকের সংকট দেখা দেয়। যার ফলে বহিরাগত শ্রমিকদের কদর বাড়তে থাকে। তবে বহিরাগত শ্রমিকরা আছে বলেই এই এলাকার কৃষি উৎপাদন এখনও ধরে রাখা সম্ভব হয়েছে। তাই আজ সকালে এখানে শ্রমিকের জন্য এসেছি। কথায় কাজে মিল হয়ে গেলে শ্রমিক নিয়ে যাবো। খাড়াতাইয়া গ্রামের কৃষক আবুল হোসেন বলেন, এই বাজারের শ্রমিকদের জন্য স্থানীয় কৃষকদের অনেক উপকার হয়েছে। কৃষকদের সুবিধার্থে এই শ্রমিকের বাজারটিকে ধরে রাখতে হবে। তাদের সুযোগ-সুবিধার জন্য সরকারী উদ্যোগে গণশৌচাগার নির্মাণ করা প্রয়োজন। জগতপুর এডিএইচ মাদ্রাসার শিক্ষক মোঃ আবদুল সালাম বলেন, এখানে ভোর থেকে সকাল ৮টা পর্যন্ত শ্রমিকের হাট বসে। এতে স্থানীয় কৃষকদের বিভিন্ন কাজে অনেক সুবিধা হয়েছে। কৃষকরা তাদের প্রয়োজন মতো শ্রমিক কাজে নিতে পারে। স্থানীয় শ্রমিক নেতা ও নিরাপদ চিকিৎসা চাই এর বুড়িচং উপজেলা শাখার সাধারণ সম্পাদক মোঃ শহীদুল্লাহ বলেন, ১৯৮৪ সাল থেকেই এখানে শ্রমিকের হাট বসে। এক সময় জগতপুর, সাদকপুর, বড়ধুশিয়া, সিদলাই এলাকার শ্রমিকরা এখানে কাজ করতে আসতো। তারা দৈনিক বাড়ি থেকে এই বাজারে আসতো আবার কাজ শেষে নিজেদের বাড়ীতে চলে যেত। যখন বহিরাগত শ্রমিকরা আসা শুরু করে তখন থেকে স্থানীয় শ্রমিকরা এই বাজারে আসা বন্ধ করে দেয়। এখন তো স্থানীয় শ্রমিকরা প্রায়ই প্রবাসে চলে গিয়েছে। তাই বহিরাগত শ্রমিকদের মাধ্যমে স্থানীয় কৃষকদের চাহিদা পুরণ করা হয়। এরা আসে বলেই স্থানীয় কৃষকদের দুঃখ কষ্ট লাঘব হয়। এই এলাকার কৃষি উৎপাদনে বহিরাগত শ্রমিকদের অবদান রয়েছে। তাদের সুবিধার্থে সরকারীভাবে খাড়াতাইয়া নতুন বাজার এলাকায় গণশৌচাগার স্থাপন করার এখন সময়ের দাবী। পয়াতের জলার পানি নিঃষ্কাশনের জন্য খাল খনন ও খাল উদ্ধারের আন্দোলনের অগ্রনায়ক বীরমুক্তিযোদ্ধা মোঃ ফরিদ উদ্দিন বলেন, খাড়াতাইয়া নতুন বাজারে দেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে দিনমজুর হিসেবে শ্রমিকদের আগমন ঘটে প্রায় ৩০ বছর পূর্বে। এক সময় এই এলাকার ধনাঢ্য ব্যক্তিদের কাচারি ঘর থাকতো। সেই সময় বহিরাগত শ্রমিকরা কাচারি ঘরে থেকে বিভিন্ন কৃষকের জমিতে কাজ করতো। যুগের পরিবর্তনের সাথে সাথে এখন আর কারো বাড়িতে কাচারি ঘর নেই। তবে শ্রমিকদের সুবিধার্থে বাজারের পাশে অনেক ঘর নির্মাণ করা হয়েছে। যেখানে শ্রমিকরা জনপ্রতি দৈনিক ২০টা ভাড়ায় থাকতে পারতেছে। এই বাজারটি অত্র এলাকার কৃষকের জন্য সুফল বনে এনেছে। তারা তাদের কৃষি পন্য উৎপাদনের জন্য সহজের শ্রমিকের সন্ধান পাচ্ছে। শ্রমিকের জন্য ছুটাছুটি করতে হয় না। আমি মনে করি এই শ্রমিকের বাজারটিকে ধরে রাখতে হবে। ধরে রাখতে হলে সরকারী ভাবে শ্রমিকদের থাকা সুবিধা ও গণশৌচাগার নির্মাণ প্রয়োজন।

  • বুড়িচং