আধুনিক বুড়িচং ব্রাহ্মণপাড়ার রূপকার আবদুল মতিন খসরু

লেখক: স্টাফ রিপোর্টার
প্রকাশ: ১ বছর আগে

Spread the love

কুমিল্লা জেলার ব্রাহ্মণপাড়া উপজেলার মাধবপুর ইউনিয়নের মিরপুর গ্রামের এক সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে ১৯৫০ সালের ১২ই ফেব্রæয়ারি আব্দুল মতিন খসরু জন্মগ্রহণ করেন। ১৯৭১ সালে পরাধীনতার শৃঙ্খল থেকে বাঙালী জাতিকে মুক্ত করতে মহান মুক্তিযুদ্ধে অংশ গ্রহণ করেন। তিনি বুড়িচং ব্রাহ্মণপাড়া থেকে ৫ (পাঁচ) বার সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। ১৯৯৬ সালে আইনমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেছেন। মৃত্যুর আগ পর্যন্ত তিনি বাংলাদেশ আওয়ামীলীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। ২০২১ সালে সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির সাভাপতি নির্বাচিত হয়েছিলেন। জাতীয় সংসদে কুখ্যাত ইনডেমনিটি বিল বাতিলের মাধ্যমে বঙ্গবন্ধুর খুনীদের বিচারের ব্যবস্থা করেছিলেন। আব্দুল মতিন খসরু ১৪ এপ্রিল ২০২১ সালে ঢাকা সিএমএইচে ইন্তেকাল করেন। প্রথম পরিচয়: ১৯৮৬ সালের কথা। আমি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি সাহিত্যে অনার্স পড়ার সময় একদিন বাড়িতে এসেছি। ব্রাহ্মণপাড়া উপজেলার বড়ধুশিয়া গ্রামে আমার বাড়ি। শশীদল রেলস্টেশন থেকে সড়ক পথে অথবা নৌকা পথে বাড়ি যেতাম। তখন জাতীয় সংসদ নির্বাচন চলছিল। আবদুল মতিন খসরু কুমিল্লা-৫ আসনের আওয়ামীলীগের মনোনীত নৌকারু প্রার্থী। নির্বাচনী প্রচারণার কাজে শশীদল যাওয়ার পথে নাগাইশ বাজারের নিকটবর্তী স্থানে আমার প্রথম পরিচয় হয়। তখন তাঁর সাথে ছিলেন ব্রাহ্মণপাড়া উপজেলার ছাত্রলীগের সভাপতি আক্তার ভাই। তিনিই আমাকে আবদুল মতিন খসরু সাহেবের সাথে পরিচয় করিয়ে দেন। তিনি সাদা পাঞ্জাবী পরিহিত সুদর্শন, লম্বা, আকর্ষনীয় ব্যক্তিত্বের অধিকারী ছিলেন। প্রথম পরিচয়ে আমি তাঁর একজন ভক্ত হয়ে যাই। সেই থেকে পথচলা শুরু। ১৯৯১ সাল। আমি ছাত্র রাজনীতিতে সক্রিয়ভাবে জড়িয়ে পরি। আমি তখন বাংলাদেশ ছাত্রলীগ চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় শাখার কার্যকরী কমিটির সদস্য। জাতীয় সংসদ নির্বাচন শুরু হল। আবদুল মতিন খসরু নৌকা প্রতীক নিয়ে আওয়ামীলীগের প্রার্থী হলেন। চান্দলা ইউনিয়নে তাঁর নির্বাচনী জনসভা চলছিল। চান্দলা কে.বি হাই স্কুলের প্রধান শিক্ষক আমার বাবা নির্বাচনী সভায় সভাপতিত্ব করছিলেন। ঐ জনসভায় সৈয়দ আব্দুল কাফি, জাহাঙ্গীর খান চৌধুরী, আবু তাহের, এডভোকেট দেওয়ান আব্দুল জলিল, এডভোকেট ছিদ্দিকুর রহমান, গৌরাঙ্গ চন্দ্র দাস, মালেক মাস্টারসহ আরো অনেকে উপস্থিত ছিলেন। খসরু সাহেব আমাকে নির্বাচনী সভায় বক্তৃতা দেয়ার জন্য সুযোগ করে দিলেন। বক্তৃতার আগে কি বলব তিনি তা শিখিয়ে দিলেন । আব্দুল মতিন খসরু ছিলেন আমাদের রাজনীতির এক মহান শিক্ষক। তিনি ১৯৯১ সালে প্রথমবার এমপি নির্বাচিত হলেন। ঢাকা থেকে চট্টগ্রাম পর্যন্ত হাইওয়ের পাশে একমাত্র আওয়ামীলীগের এমপি ছিলেন তিনি। তরুন এমপি হিসেবে তিনি বঙ্গবন্ধু কন্যা জননেত্রী শেখ হাসিনার কাছে যাওয়ার সুযোগ পেলেন। সংসদে এমপি হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালনের মধ্য দিয়ে সকলের দৃষ্টি আকর্ষন করেন। তিনি ১৯৯৪ সালে আমেরিকার প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে বাংলাদেশের প্রতিনিধিত্ব করেন। তখন তাঁর প্রচেষ্টায় আন্তর্জাতিক সংস্থা কর্তৃক ব্রাহ্মণপাড়া আধুনিক হাসপাতালের জন্য অর্থ বরাদ্দ হয়। ১৯৯৪ সালে বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়ালেখা শেষ করে নিজ গ্রামে ফিরে আসার কিছু দিন পর আমি শিক্ষক হিসেবে আমীর হোসেন জোবেদা ডিগ্রি কলেজে যোগদান করি। সে বছর খসরু সাহেব আমাকে ব্রাহ্মণপাড়া উপজেলা যুবলীগের আহবায়কের দায়িত্ব প্রদান করেন। পরবর্তীতে ধারাবাহিক ভাবে তিনি আমাকে উপজেলা আওয়ামীলীগের যুগ্ম সাধারন সম্পাদক, যুগ্ম আহবায়ক ও সহ-সভাপতি হিসেবে মনোনয়ন দেন। তিনি ছিলেন আমাদের পরিবারের একজন শুভাকাঙ্খী ও অভিভাবক। তাঁর ঋন কখনো শোধ হবে না। ২০০৯ সালে যখন আমি কলেজের ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষের দায়িত্ব পাই। তখন কলেজের সভাপতি হিসেবে আমরা স্থানীয় এমপি হিসেবে আব্দুল মতিন খসরু সাহেব কে মনোনীত করি। ২০১৩ সালে তিনি আমাকে আমীর হোসেন জোবেদা ডিগ্রি কলেজের অধ্যক্ষ হিসেবে নিয়োগ প্রদান করেন। তিনি কলেজ গভর্ণিং বডির সভাপতি হিসেবে নিয়মিত কলেজে মিটিংয়ে আসতেন। কলেজের শিক্ষকদের অনেক সম্মান করতেন। ছাত্র-ছাত্রীদের সাথে মতবিনিময় করতেন। তাদেরকে পড়ালেখার পাশাপাশি খেলাধুলা, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণের জন্য উৎসাহ দিতেন। ছেলে মেয়েদের নিয়মিত নামাজ পড়তে অনুপ্রানিত করতেন। কলেজের সকল নিয়োগ পরিক্ষার সময় সভাপতি হিসেবে উপস্থিত থাকতেন। ভালো শিক্ষক নিয়োগে কখনো আপোষ করতেন না। একবার ইন্টারভিউ শেষে আমি তাকে বললাম আমরা নিয়োগ বোর্ডের সদস্যদের সম্মানী ভাতা প্রদান করে থাকি। আপনি সভাপতি হিসেবে সম্মানী পাবেন। তিনি সাথে সাথে বললেন আল্লাহ আমাকে অনেক কিছু দিয়েছেন। আমি সম্মানী খাওয়ার সভাপতি নই। ইন্টারভিউ শেষে ঐ দিনের আপ্যায়নসহ অন্যান্য খরচের জন্য ৩০,০০০ টাকা তিনি প্রদান করেন। আমাকে কলেজ থেকে এক টাকাও খরচ করতে দেননি। তিনি ছিলেন একজন সাদা মনের মানুষ। তাঁর সততা ছিল হিমালয়সম। তিনি ছিলেন গ্রেট, তিনি ছিলেন অতুলনীয়। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে ১৯৭৫ সালের ১৫ আগষ্ট নির্মমভাবে হত্যার পর ১৯৯৬ সালে বাংলাদেশ আওয়ামীলীগ পূনরায় সরকার গঠন করে। এই সরকারের আইনমন্ত্রী ছিলেন এডভোকেট আব্দুল মতিন খসরু। মন্ত্রী হওয়ার পর বুড়িচং ব্রাহ্মণপাড়ার অভূতপূর্ব উন্নয়ন সাধন করেন। তিনি বুড়িচং-ব্রাহ্মণপাড়া-মিরপুর সড়ক পাকা করেন। কুমিল্লা-শংকুচাইল-সালদানদী সড়ক পাকা করেন। প্রায় ৪০০ টি ব্রিজ কালভাট নির্মান করেন। অসংখ্য স্কুল- কলেজ, মাদ্রাসা-মসজিদ প্রতিষ্ঠা করেন। শিক্ষার মান উন্নয়নে তার অবদান অনস্বীকার্য। তিনি গ্রামীন যোগাযোগ ব্যবস্থার ব্যাপক উন্নয়ন করেন। শতভাগ বিদ্যুতায়নের ব্যবস্থা করেন। এজন্য তাকে বলা হয় আধুনিক বুড়িচং ব্রাহ্মণপাড়ার জনক। আমি একদিন কথা প্রসঙ্গে বললাম এমপি মহোদয় আমার একজন গরীব ছাত্রী আছে। বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়–াশোনা করছে। আপনি তাকে একটু সহযোগিতা করবেন। তিনি বললেন ঠিক আছে। তারপর অনেক কথা হলো। তিনি আমাকে জানালেন সংসদ সদস্য হিসেবে পাওয়া সম্মানীর সমস্ত টাকা গরীব শিক্ষার্থীদের জন্য তিনি ব্যয় করেন। একথা তিনি কখনো কাউকে বলেননি। তিনি অসংখ্য মানুষকে চাকুরী দিয়েছেন বিনিময়ে কানাকড়ি গ্রহণ করেননি। তিনি কখনো বদলী বানিজ্য করেননি। ঘুষ, টেন্ডারবাজি, দূর্নীতি ছিল তাঁর জন্য হারাম। তিনি ছিলেন রাজনীতির অঙ্গনে কষ্টি পাথরে যাচাই করা এক বর্ণাঢ্য রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব। মৃত্যু চিরন্তন। প্রত্যেক মানুষকে মৃত্যুর সাধ গ্রহণ করতে হবে। আবদুল মতিন খসরু ছিলেন একজন খোদাভীরু মানুষ। তিনি তাহাজ্জুদের নামাজ পড়তেন। এমন আমলী মানুষ আমার জীবনে খুব কম দেখেছি। তাঁর হঠাৎ মৃত্যুর সংবাদ ছিল আমাদের কাছে বিনামেঘে বর্জ্রপাতের মতো। তিনি ২০২১ সালের ১৪ এপ্রিল প্রথম রমজানের দিন করোনা মহামারীতে মৃত্যু বরণ করেন। তাঁর মৃত্যু আমাদের অপুরনীয় ক্ষতি হয়েছে। তাঁর শূণ্যতা কোনদিন পূরন হবার নয়। আমরা প্রতিদিন সকল ভালো কাজে প্রিয় নেতাকে শ্রদ্ধার সাথে স্মরন করি। তাঁর শারীরিক মৃত্যু হলেও তিনি আমাদের হৃদয়ের গহীনে বেঁচে থাকবেন অনন্তকাল। আমরা তাঁর আত্মার শান্তি কামনা করছি, দোয়া করছি আল্লাহ-তালা যেন তাকে বেহেশত নসীব করেন। মোঃ নজরুল ইসলাম, অধ্যক্ষ আমীর হোসেন জোবেদা ডিগ্রি কলেজ শিদলাই, ব্রাহ্মণপাড়া, কুমিল্লা।

  • ব্রাহ্মণপাড়া